
ভারতের জঙ্গলে চিতা বাঘ। ছবি: উইকিপিডিয়া
রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলা। মৈদং ইউনিয়নের দুর্গম মৌন আদাম এলাকা। গত মার্চের ৩ তারিখ। রাঙা চোগা চাকমা (৩৫) খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘর মেরামতের জন্য বাড়ির পাশের জঙ্গলে যান গাছ কাটতে। এ সময়ই হঠাৎ একটি প্রাণী তাকে আক্রমণ করে। রাঙা চোগা চাকমার দাবি ওটা একটা বাঘ। এ সময় তার মুখের বাঁ পাশে জখম হয়। ক্ষতবিক্ষত হয় বাম কান ও চোখের একটা অংশ এবং হাতের তালু। শরীরের বেশ কয়েকটি জায়গায় ক্ষত হওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। একপর্যায়ে রাঙা চোগার চিৎকারে প্রাণীটি তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।
দুর্গম এলাকা হওয়ায় চিকিৎসার জন্য রাঙা চোগাকে কাঁধে করে দুই ঘণ্টা হেঁটে ফকিরাছড়া গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে স্থানীয় বৈদ্যসহ অন্যদের বেগ পেতে হয় রক্ত বন্ধ করতে। পরে গুরুতর আহত রাঙাকে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

দ্বিতীয় ঘটনাটি মাস ছয়েক আগের। তারিখটা ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪। ঘটনাস্থল রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা। যদ্দূর জানা যায়, ৩০ নম্বর সারোয়াতলী ইউনিয়নের চিন্তারাম ছড়ার পাহাড়ে গরু চরাচ্ছিলেন যৌথ খামার গ্রামের বাসিন্দা এক চাকমা। দুপুরে তার একটি গরুকে বাঘসদৃশ একটি প্রাণী আক্রমণ করে আহত করে। এর আশপাশের সময় পাহাড়ে বাঘ দেখার দাবি করেন আরো কেউ কেউ। একপর্যায়ে ‘বাঘের’ খবরটি ছড়িয়ে পড়ে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে। স্থানীয় কারবারির দাবি, মাঝারি আকারের বাঘের মতো একটি প্রাণী বনের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে চিতা বাঘ এমনকি বাঘের উপস্থিতি একটা সময় ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে কাপ্তাই বাঁধ তৈরির আগে গাছ কাটা হচ্ছিল কাসালং রিজার্ভের। ওই সময় পাবলাখালীর মাইনি ও মাহিল্লা এলাকায় বাঘ শিকারের বর্ণনা মেলে এনায়েত মাওলার ‘যখন শিকারি ছিলাম’ বইয়ে।
তেমনি বয়স্ক স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে শোনা যায় বড় বাঘ আর চিতার নানা কাহিনি। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে কালেভদ্রে স্থানীয়দের থেকে বাঘ দেখার খবর মেলে।
তবে ওপরের ঘটনা দুটির ধরন ও পরে ওই এলাকাগুলোতে বাস করাদের থেকে খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, দুই কাণ্ডেরই নায়ক বা খলনায়ক চিতা বাঘ।
একটা সময় অনেক বন্যপ্রাণী গবেষক পর্যন্ত ধরে নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বনানী থেকে বুঝি বা চিতা বাঘ বিদায় নিয়েছে। নানা তথ্য-প্রমাণ জানান দিচ্ছিল, এরা আছে। তবে প্রমাণ মিলছিল না। শুরুর নিশ্চিত প্রমাণগুলোর একটি হাজির করে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ) নামের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করা একটি সংগঠন। ২০১৫ সালে সাঙ্গু রিজার্ভে তাদের ক্যামেরা ট্র্যাপে বন্দি হয় একটি চিতা বাঘ। বছর তিনেক আগে ‘ডিটেকটিং দ্য স্পট : আ রিভিউ অন ল্যাপার্ড অকারেন্সেস ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন মুনতাসির আকাশ, স্কট ট্রেগারস, তানিয়া জাকির, শাহরিয়ার সিজার রহমান, ফাতেমা-তুজ-জোহরা খালেক মিলা ও অনিমেষ ঘোষ। চিতা বাঘ নিয়ে বাংলাদেশে এমন গবেষণা এটাই প্রথম। সেখান থেকেও জানা যায় বাংলাদেশে চিতা বাঘদের সাম্প্রতিক বিচরণের নানা খবর। গবেষণাপত্রটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চিতা বাঘ দেখার পাঁচটি ও কক্সবাজার অঞ্চলে চিতা বাঘ দেখার নিশ্চিত দুটি তথ্যের কথা বলা হয়েছে।

সব কিছু মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তত কয়েকটি এলাকায় চিতা বাঘের আলাদা ছোট বসতি আছে যে তাতে সন্দেহ নেই। রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ সুপ্রিয় চাকমার বছর কয়েক আগের গবেষণার ফলাফল নিশ্চিত করে বান্দরবানের অন্তত একটি এবং রাঙ্গামাটির দুটি সংরক্ষিত অরণ্যে চিতা বাঘ আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার কিংবা সিলেটের যে জঙ্গলেই যাই, চিতা বাঘের খোঁজ করি। হলুদ জমিনে কালো ফোঁটার আশ্চর্য সুন্দর এই জন্তুটির ট্রেইল অনুসরণ করে হানা দিয়েছি কত জঙ্গলে! যদিও এখন পর্যন্ত চর্মচক্ষে এদের দেখা পাইনি। তবে আজকে এই লেখার কারণ ৩ মে আন্তর্জাতিক চিতা বাঘ দিবস।
কাপ্তাই লেক ভ্রমণে একবার পরিচয় হয়েছিল হাসিখুশি এক চাকমা দম্পতির সঙ্গে। সুবলং ঝরণায় পৌঁছার আগে তাদের ছোট্ট একটা দোকানে চা-বিস্কুট খাওয়া আর জিরিয়ে নেওয়া যায়। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হয় তাদের সঙ্গে।
একসময় ওদিককার জঙ্গলে নাকি বিস্তর বন্যপ্রাণী দেখা যেত। শান্তি চাকমা জানালেন, শেষ চিতাবাঘের ডাক শুনেছেন ১৯৮৫ সালের দিকে। সন্ধ্যা নামতেই ডাকতে শুরু করত। চলত সারা রাতভর। দরজা-জানালা লাগিয়ে বসে থাকতেন তারা। টানা তিন রাত এভাবে ডেকে চলে ওটা। তারপর আর শোনা যায়নি। সময়টা ছিল বাঘদের মিলনকাল। তাই হন্যে হয়ে সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীর খোঁজ করছিল।
সালটা ২০১১। বাঘের খোঁজে সাঙ্গু রিজার্ভের গহিনে যাওয়ার জন্য থানচি থেকে নৌকা ভাড়া করে রওনা দিয়েছিলাম। নৌকার দুই মাঝি মারমা। এর মধ্যে একজন বয়সে তরুণ, হাসি-খুশি। ভাব জমে গেলে অকপটে স্বীকার করলেন, জঙ্গলে হরিণ শিকারে যাওয়ার কথা। মেলে দিলেন গল্পের ঝাঁপি। দুই বছর আগে (২০০৯ সাল) শিকারে গিয়েছিলেন, মোদকের মিয়ানমার সীমান্ত লাগোয়া পাহাড়ে। তখন আশ্চর্য সুন্দর দুটো প্রাণী মুখোমুখি হয়ে যান আচমকা। ছোটাছুটি করে খেলছিল তারা নিজেদের মধ্যে। চিতা বাঘ। তবে মানুষজন দেখে মুহূর্তেই জঙ্গলে হাওয়া।
আলীকদমের মিয়ানমার ঘেঁষা একটি সংরক্ষিত বন। মুরং এক যুবক যাচ্ছেন জুমের ক্ষেতে। পথটা চলে গেছে গহিন অরণ্য দিয়ে। হঠাৎ দেখলেন ওটাকে। বিদ্যুৎ চমকের মতো লাফিয়ে পড়ল তার পথের একটু সামনে। হলুদ জমিনে কালো ফোঁটার চিতা বাঘ। কাঁটা দিয়ে উঠল শরীর, রোমাঞ্চে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল জন্তুটা। তারপরই এক লাফে হারিয়ে গেল পাশের জঙ্গলে। ঘটনাটা ২০২১ সালের এপ্রিলের।
গত বছরের ডিসেম্বরের ঘটনা। বান্দরবানের আলীকদমের মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা এক ম্রোদের পাড়ায় গিয়েছি। একটা মেলা চলছিল। একপর্যায়ে আলাপ এক তরুণের সঙ্গে। গল্পচ্ছলেই সীমান্তের কাছের পাহাড় দেখিয়ে বলল, গত বছর ওই পাহাড়ে গিয়ে বিপদে পড়েছিলাম। হরিণ শিকারের জন্য গিয়েছিলাম। জঙ্গলের মধ্যে একটা খোলা জায়গায় এলাম, এমন সময় উল্টো পাশ থেকে বড় একটা চিতা বাঘ আমার সামনে চলে এলো। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে বাঘটাও ভড়কে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি এই সুযোগে এক দৌড়ে উল্টো দিক দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে।’
বাঘের তুলনায় ছোট শিকারেও চলে যায় চিতা বাঘের। তেমনি ছোটখাটো জঙ্গলেও এরা আত্মগোপন করে থাকতে পারে। ভারতে তাই অনেক গ্রামঘেঁষা ছোট ছোট জঙ্গলেও চিতা বাঘদের আস্তানা। মাঝে মাঝে একটু বেশি আশাবাদী হয়ে ভাবি, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি শহরের আশপাশের কোনো কোনো পাহাড়ে হয়তো এখনো নিজেদের ধূর্ততা আর আত্মগোপনের অভ্যাসকে কাজে লাগিয়ে টিকে আছে চিতা বাঘেরা। অবশ্য এসব পাহাড়ি এলাকায় চিতা বাঘ লুকিয়ে থাকার মতো জায়গা থাকলেও তাদের খাবার জন্য শিকার আছে কমই। বেশ কয়েক বছর আগে যেমন এক সাংবাদিক রাতে দীঘিনালার কাছে রাস্তার ওপরে বেশ বড় একটি বাঘের মতো প্রাণীকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি খাগড়াছড়ি শহরের কাছেই কোনো প্রাণীর আক্রমণে মারা পড়েছিল একটি গরু। রহস্যগুলো রহস্যই থেকে যাক। মানুষের চোখ এড়িয়ে ভালো থাকুক দেশের সব চিতা বাঘ।